দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকার (২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯) ভিন্ন চোখে সাহসী দুই রোভারের গল্প
- আহসান জোবায়ে,২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯
প্রতিবছরের মতো
এই বছরের একুশে ফেব্রুয়ারির দিনটি হয়তো অন্যসব বছরের মতোই শুরু হওয়ার প্রস্তুতি
ছিল সবার। কিন্তু এক রাতে পাল্টে গেল হিসেবটা। ঠিক আগের দিন রাতে চকবাজারে আগুন
লাগার ঘটনায় স্তব্ধ দেশ। চুড়িহাট্টার ওই সরু গলিটার ভেতরে ঢুকে মনে হলো, পুরো গলিটাতেই
অগ্নিকাণ্ডের প্রচণ্ড ঝুঁকি। সরু গলিটার ভেতরে ঢুকলেই চোখে পড়বে দু-পাশের ঘরবাড়ি,
দোকানপাট পুড়ে কালো হয়ে গেছে, এখানে-ওখানে পড়ে
আছে পুড়ে যাওয়া মোটরসাইকেল, রিকশা, পিকআপ
ভ্যান, প্রাইভেটকার ইত্যাদির ধ্বংসাবশেষ।
পুরো পরিবেশ
ভয়ঙ্কর এই অগ্নিকাণ্ডের নির্মম সাক্ষীই বহন করছে যেন। বাতাসে পরিচিত সেই পোড়া
ঝাঁঝালো গন্ধটা নেই। পুড়ে কয়লা হয়ে যাওয়া মানুষের আষ্টে গন্ধের সাথে কেমিক্যালের সুবাসও
পাওয়া যাচ্ছিল। হাঁটতে গিয়ে পায়ের দিকে তাকাতে দেখা যায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে দুমড়ানো
মোচড়ানো অনেক ক্যানিস্টার। কোনোটা গায়ে মাখা সুগন্ধির, কোনোটা
অ্যারোসলের, ছড়িয়ে আছে অজস্র প্রসাধনীর টিউব। দোকানগুলোর
সামনে পড়ে আছে বস্তা, সাইডে দাঁড়িয়ে থাকা ভ্যানের কাঁচা
সবজিগুলোও ফ্রাই হয়ে গলে পড়ে আছে। ফায়ার সার্ভিসের ছিটানো পানিতে সেগুলো ভিজে
হয়েছে মখমলের মতো নরম। সেখানে পড়ে থাকতে দেখা যায় ভস্মীভূত হওয়া পিকআপ, প্রাইভেটকার, অটোরিকশা, মোটরসাইকেল,
বাইসাইকেল, ঠেলাগাড়ি, ভ্যান-রিকশাসহ
কেমিক্যালের বিভিন্ন সরঞ্জামের কৌটা। ওয়াহেদ ম্যানশনের ভেতরে অন্ধকার, ভূতুড়ে অবস্থা। গিয়ে দেখি সর্বত্র স্প্রের পোড়া কৌটা। প্লাস্টিকের জঞ্জাল।
সিঁড়িতে, মেঝেতে পোড়া বস্তু। আগুন নেভানোর জন্য পানি দেওয়ায়
মেঝে-সিঁড়ি থকথকে হয়ে পড়েছে। যেখানে পা রাখি সেখানেই পুড়ে যাওয়া জঞ্জাল। বসত ও
গুদামঘর পাশাপাশি। একপাশে মানুষ বাস করছিল। তাদের পুড়ে যাওয়া আসবাবপত্র, চেয়ার-টেবিল, থালা-বাসন পড়ে আছে। শুধু মানুষগুলো
নেই। আরেক পাশে গুদামের দগ্ধ মালামাল। ফায়ার সার্ভিস সদস্যরা রাত থেকেই আহত ও
নিহতদের উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেলের পাঠাতে থাকে।
সেখানে দায়িত্ব
পালন করেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় রোভার স্কাউট গ্রুপের দু’জন সিনিয়র রোভার মেট।
প্রকাশ করেন তাদের বাস্তব অভিজ্ঞতা।
অনুপ্রেরণা একটাই ‘সেবার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করা’
আন্তর্জাতিক
মাতৃভাষা দিবসে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সেবা প্রদানের জন্য দায়িত্বরত ছিলাম। এই
ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের খবর শুনে আমার গ্রুপের ডিজাস্টার রেসপন্স প্রশিক্ষণ সম্পন্ন
করা রোভারদের সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করি। টানা ৩ দিন ক্যাম্পাস বন্ধ থাকায়
প্রশিক্ষণ গ্রহণকারী কাউকে পাচ্ছিলাম না। রাত ১২টা ৫০ মিনিটে আমাদের সিনিয়র রোভার
মেট আহসান হাবীব বলেন,
তিনি সেখানে যাবেন। আমিও যেহেতু ডিজাস্টার রেসপন্স প্রশিক্ষণে
অংশগ্রহণ করেছি সেহেতু নিজের বিবেকের দায়বদ্ধতা থেকে সেখানে চলে যেতে বাধ্য হলাম।
পিপিই (আমার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র) সাথে ছিল না, কাজেই সরাসরি
অগ্নিনির্বাপণে সহযোগিতা করিনি বরং সেখানে উত্সুক জনতার ঢল সামলাতে আইনশৃঙ্খলা
বাহিনীকে সহায়তা করি এবং পরবর্তীতে লাশ সনাক্তকরণে কাজ করি। অগ্নিদগ্ধ ও আহতদের
প্রাথমিক চিকিত্সা এবং মৃতদেহ স্ট্রেচারে বহন করে অ্যাম্বুলেন্সে ওঠানোর কাজ চলে
ভোর পর্যন্ত। অতঃপর ক্লান্ত দেহে আবারো কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আসি। বাংলাদেশ স্কাউটস
থেকে আমাকে মুঠোফোনে জানানো হয় চকবাজারে উত্সুক জনতার কারণে উদ্ধার কাজ ব্যাহত
হচ্ছে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান স্যারে সাথে
প্রভাতফেরিতে অংশ নেওয়া ২০ জন রোভার নিয়ে আবারো পৌঁছে যাই ঘটনাস্থলে। অতঃপর
দুপুরের দিকে সেখানের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়। বাংলাদেশ স্কাউটসের সমাজসেবা ও
স্বাস্থ্য বিভাগের পরিচালক মো. গোলাম মোস্তফা আমাকে মুঠোফোনে জানান, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আহত রোগিদের এবং স্বজনহারা মানুষদের
সহযোগিতায় এগিয়ে আসতে। আমাদের গ্রুপের ১৪ জন রোভার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে
দায়িত্বরত ছিলেন। এরইমধ্যে তাদের দায়িত্ব শেষ হওয়াতে তাদের নিয়ে চলে আসি ঢাকা
মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। একটি বিভীষিকাময় রাত আর দিনের পরিসমাপ্তি হয়। ক্লান্ত
শরীর যেন হার মানছিল, কিন্তু অনুপ্রেরণা একটাই ‘সেবার জন্য
যথাসাধ্য চেষ্টা করা।’
মো. এনামুল
হাসান কাওছার
সিনিয়র রোভার
মেট ও সাধারণ সম্পাদক
জবি
রোভার-ইন-কাউন্সিল
আমি প্রায় ১০-১২টি লাশ সনাক্তকরণ করি
রাত ১২টা ৫০
মিনিটে রোভার কাওছারের মুঠোফোনের আওয়াজে ঘুম ভাঙে। শুনতে পাই পুরান ঢাকার চকবাজারে
আগুন লাগছে। পরবর্তীতে দেশের একজন নাগরিক হিসেবে রাষ্ট্রের যেকোনো দুর্যোগে
আক্রান্তদের পাশে দাঁড়ানোর দায়বদ্ধতা এবং বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল
ডিফেন্সের একজন কমিউনিটি ভলান্টিয়ারের দায়বদ্ধতা থেকে অনুভূত হয় এই দুর্যোগে আমাকে
পাশে দাঁড়াতে হবে। অতঃপর আমি পিপিই (আমার প্রয়োজনীয় জিনিস) নিয়ে ২১ তারিখ রাত ১টা
৪০ মিনিটে চকবাজারের উদ্দেশ্যে রওনা হই। চকবাজার পৌঁছার পর আমি আগে শুনি কোন
জায়গায় আাাগুনের উত্পত্তি। উত্পত্তি স্থলে গিয়ে আমি ফায়ার সার্ভিস ও ফায়ার
ফাইটারদেরকে সহযোগিতা করি। যেহেতু আমি একজন ভলান্টিয়ার, তাই আগুন নেভানোর
কাজ আমাদের করা নিষেধ, তাই তাদেরকে আমার সাধ্যমতো সহযোগিতা
করি। পরবর্তীতে ফায়ার সার্ভিসের কর্তব্যরত ফাইটাররা ভলান্টিয়ারদের লাশ সনাক্তকরণে
কিছু কাজ দেয়, তারই ধারাবাহিকতায় আমি প্রায় ১০-১২টি লাশ
সনাক্তকরণ করি ও মোট প্রায় ৪০-৫০টি লাশ ভোর রাত ৪টা ৩০টা পর্যন্ত অ্যাম্বুলেন্সে
ওঠাতে সহযোগিতা করি। কাজ করতে গিয়ে অনেকটা দুর্বল হই। কারণ লাশের চেহারা দেখে
সনাক্ত করা সম্ভব নয়। আমার জীবনের প্রথম এই এত বড় মর্মান্তিক ঘটনার সাহায্যার্থে
সম্পৃক্ত হতে পেরে নিজেকে অনেক সৌভাগ্যবান মনে করছি ও সাথে এই মানবসৃষ্ট দুর্যোগের
কারণে স্বজনহারা পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানাচ্ছি। অপরিকল্পিত কেমিক্যাল কারখানা
অচিরে মানববসতিকে সরিয়ে নেওয়ার জোর দাবি জানাই।
মো. আহসান হাবীব
সিনিয়র রোভার
মেট, জগন্নাথ
বিশ্ববিদ্যালয় রোভার স্কাউট গ্রুপ
নিউজ ইউ আর এল- ইত্তেফাক প্রিন্ট এডিশন
No comments:
Post a Comment